Friday, November 6, 2015

নারীবাদ কী ও কেন : একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা!

মানুষ হিসেবে নারীর পরিপূর্ণ অধিকারের দাবীর নাম নারীবাদ। নারীবাদ ইংরেজি feminism শব্দটি থেকে এসেছে। কোন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বা সমাজবিজ্ঞানের মতবাদকে 'বাদ' বা ism বলা হয়। সেই হিসেবে নারীবাদ এমন একটি বাদ বা মতবাদ যা সমাজবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট, যেখানে নারী অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। তো, কী সেই অধিকার? পুরুষের সমান অধিকার, মানুষের অধিকার।

নারীবাদ নারীদের আন্দোলন নয়, নারীদের জন্য আন্দোলন। নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নারীবাদীদের মধ্যে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বা মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে।

এই মতাদর্শগত পার্থক্য ব্যাপারটা কেমন তা একটা উদাহরন দিলে সহজেই বোঝা যাবে। যেমন ইসলাম ধর্মের কথাই ধরা যাক। মুসলমানদের মধ্যে অনেক সাবগ্রুপ রয়েছে। এদের সবার উদ্দেশ্য এক তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হলেও এদের নীতি ও কর্ম-পদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন, তাবলিগ জামাতের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্বশুদ্ধির আন্দোলন, জামাতে ইসলামের রাজনৈতিক আন্দোলন, পীর-মুরশিদদের আধ্যাত্মিক আন্দোলন ও আল-কায়েদার জিহাদি আন্দোলন।

তেমনি সব নারীবাদের মূল উদ্দেশ্য এক তথা নারীমুক্তি হলেও এদের নীতি ও কার্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে। এই মতাদর্শগত পার্থক্য থেকে বিভিন্ন নারীবাদের উৎপত্তি হয়েছে।

কয়েকটি প্রভাবশালী ও আলোচিত নারীবাদ হল- উদারনৈতিক নারীবাদ, আমূল নারীবাদ, মার্ক্সীয় নারীবাদ, পরিবেশ নারীবাদ ইত্যাদি।

(১) উদারনৈতিক নারীবাদ (Liberal Feminism)

উদার নারীবাদের মূল কথা হচ্ছে প্রতিটা মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। উনিশ শতকে উদার নারীবাদের লক্ষ ছিল গনতান্ত্রিক নির্বাচনে নারীদের ভোটাধিকার অর্জন। বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভোটাধিকার অর্জন করতে পারলেও আজও পৃথিবীর অনেক দেশে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।

উদারনৈতিক নারীবাদীরা মূলত সমাজসংস্কারে বিশ্বাসী। এরা মনে করে, বিদ্যমান সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান, আইন-কানুন সংস্কার ও সংশোধন করে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও অসমতা দূর করা সম্ভব।

বর্তমান যুগের উদার নারীবাদীদের দাবী হচ্ছে নারীদের যোগ্যতা অনুসারী যেকোন পেশা বেছে নেয়ার অধিকার থাকতে হবে। এক্ষেত্রে নারীদের কম বেতন দেয়া চলবেনা।

এরা আরো দাবী করেন যে, নারী যেহেতু সন্তান জন্ম দিয়ে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে, তাই সন্তান প্রসবকালীন সময়ে নারীদের সবেতন ছুটি দিতে হবে। আর শিশু যেহেতু নারীর একার নয়, তাই শিশু পালনে পুরুষদের অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে।

মেরি ওলস্টোন ক্রাফট, জন স্টুয়ার্ট মিল, হ্যারিয়েট টেইলর উদার নারীবাদের প্রবক্তা। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই ধরনের নারীবাদের সমর্থক ছিলেন। বাংলাদেশে মূলত যে ধরনের নারীবাদের চর্চা বা আন্দোলন দেখা যায় তা মূলত এই উদারনৈতিক নারীবাদই।

(২) আমূল নারীবাদ (Radical Feminism)

এই নারীবাদের মুলকথা হল পুরুষ নারীকে শোষন করে যৌন নিগ্রহের মাধ্যমে। এরা নারী-পুরুষের বিচ্ছেদে বিশ্বাসী। পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি ও পুরুষের সংগে নারীর সম্পর্ককে অস্বীকার করে নারীর স্বাতন্ত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই নারীবাদীরা।

আমূল নারীবাদীরা পুরুষকে প্রতিপক্ষরুপে চিহ্নিত করে প্রচলিত বিবাহ রীতিকে অস্বীকার করে। এরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী যাতে রাষ্ট্র ও পুরুষদেরও মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখার দায় সমানভাবে বহন করতে হয়। এরা সমকামে বিশ্বাসী ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী-পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী।

শুলে মিটেল ফায়ারস্টোন, কেট মিলেট, মারিয়েন ফ্রেঞ্চ আমূল নারীবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিনকে এই ধরনের নারীবাদের চর্চা করতে দেখা যায়।

নারীবাদের এই ধারাকে অনেকে উগ্র নারীবাদ বলে অভিহিত করেন। নারী-পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এরা মূলত পুরুষতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে পুরুষতন্ত্রেরই উল্টোপিঠ নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় বলেও অনেকে আমূল নারীবাদের সমালোচনা করেন।

(৩) মার্ক্সীয় নারীবাদ (Marxist Feminism)

মার্ক্সীয় নারীবাদ মতে পুঁজিবাদ আর পুরুষতন্ত্র অবিচ্ছেদ্য। একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। এই মতবাদ অনুসারে ব্যক্তিমালিকানা বা শ্রেনীবৈষম্য হচ্ছে নারী নির্যাতন ও শোষনের কারন। পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই নারী মুক্তি সম্ভব বলে এরা মনে করেন।

মার্ক্সীয় নারীবাদে পরিবার সংগঠনের মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের যাবতীয় আর্থিক দায়-দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত। সাম্যবাদী সমাজের বিয়েতে থাকবেনা কোন ধরনের আর্থিক বা ভরণ-পোষণের দ্বায়িত্ব নেয়ার চুক্তি। ফলে নারী-পুরুষের সম্পর্ক গড়ে উঠবে তাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর, পারস্পারিক বোঝাপড়া ও ভালবাসার উপর।

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের রচনাকে ভিত্তি করে এই নারীবাদ রচিত। লেনিন, অগাস্ট বেবেল, ক্লারা জেটকিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমূখ পরবর্তীতে এই মার্কসীয় নারীবাদে ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশে নারীবাদ: একটি পর্যালোচনা

বাংলাদেশে নারীবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয় হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীবাদের তুলনায় তা একটু ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে আমূল নারীবাদের প্রভাব না থাকলেও এদেশের নারীবাদের ইতিহাসে আমূল পরিবর্তন এসেছে।

উপমহাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যুগযুগ ধরে নারীরা পুরুষ কর্তৃক শোষন ও নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আসছে। পারিবারিক কাঠামোর মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র নারীকে বন্দী করে রেখেছে কখনো সমাজের নামে, কখনো ধর্মের নামে আবার কখনো পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে। এছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার যেমন সতিদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির মাধ্যমে নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের হাত ধরে বাংলায় যে ধরনের নারীবাদের চর্চা ও আন্দোলনের শুরু হয় তা মূলত উদারনৈতিক নারীবাদই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আধুনিক সময়ের বাংলাদেশে এখনো ডমিনেন্ট ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট হিসেবে এই উদারনৈতিক নারীবাদ চর্চারই জয়জয়াকার দেখা যায়।

বাংলাদেশে উদারনৈতিক নারীবাদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও আমূল নারীবাদের কথাও শোনা যায়। আমূল নারীবাদ নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলেন তসলিমা নাসরিন।

বাংলাদেশে নারীবাদ বিষয়ে যারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন তাদের মধ্যে সারা হোয়াইট, ক্রিস্টার্ন ওয়েস্টগার্ড ও ভ্যানশেন্ডেল, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, নায়লা কবির, রওনক জাহান, মাহমুদা ইসলাম, নাজমা চৌধুরী, খালেদা সালাহ উদ্দীন, মেঘনা গুহ ঠাকুরতা ও আনু মুহম্মদ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মভীরু ও স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি বেশি অনুরক্ত থাকায় আমূল নারীবাদ এদেশে কোন প্রভাব ফেলতে না পারলেও উদারনৈতিক নারীবাদী আন্দোলন এখানে বেশ সমাদৃত ও সফল হয়েছে বলা যায়।

No comments:

Post a Comment