Thursday, November 26, 2015

জেন্ডার বা লিঙ্গ বৈষম্য কী ও কেন?

সেক্স হচ্ছে নারী ও পুরুষের প্রাকৃতিক বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে জেন্ডার হচ্ছে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত নারী ও পুরুষের সামাজিক বৈশিষ্ট্য বা ভূমিকা। সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সামাজিক ভূমিকার পার্থক্যকে চিহ্নিত করতে জেন্ডার শব্দটি ব্যবহার করেন।

যেমন, সন্তান গর্ভধারন ও পুরুষের মুখে দাড়িগোঁফ ওঠা যথাক্রমে নারী ও পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে, সন্তান প্রতিপালন, রান্নাবান্নার দ্বায়িত্ব এককভাবে নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া বা পরিবারের সদস্যদের আর্থিক ভরণপোষণের দ্বায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পন হচ্ছে যথাক্রমে নারী ও পুরুষের জেন্ডার ভূমিকা।

জেন্ডার কোন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নয়। এটা সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত বৈশিষ্ট্য। তাই সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত জেন্ডার ভূমিকা অনেক সময় নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই নির্ধারিত জেন্ডার ভূমিকার কারনেই সমাজ নারীকে যেমন বিমানের পাইলট হিসেবে দেখতে পছন্দ করে না, তেমনি রান্নাঘরে পুরুষের উপস্থিতিও সমাজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না।

প্রচলিত জেন্ডার ধারণায় নারী হলো দুর্বল, কোমল, আবেগপ্রবণ, শান্ত ও নম্র। অপরদিকে পুরুষদের  কঠোর, সবল, যুক্তিবাদী ইত্যাদি বলে বিবেচনা করা হয়। নারী-পুরুষ সম্পর্কে এসব স্টোরিওটাইপ ধ্যান-ধারনা তৈরির পিছনে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যেমন দায়ী; তেমনি এর পিছনে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও জড়িত।

চর্যাপদকে যদি বাঙলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়, তাহলে বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতির বয়স হাজার বছরের কম নয়। এই হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজলে সমাজে কেবল নারীর অধস্তন অবস্থাই চোখে পড়ে। শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতির মাঠে নারীর অংশগ্রহন থাকলেও সেটা পুরুষের তুলনায় অতি নগণ্য।

নারীদের এই পিছিয়ে থাকার কারন যে তাদের মেধাশক্তি বা যোগ্যতার অভাব ছিল সেটা কিন্তু মোটেই নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিক যুগে নারীদের সফলতার চিত্র থেকে সহজেই সেটা বোঝা যায়। নারীর এই অধস্তনতার কারন হিসেবে তাই পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় ও আর্থসামাজিক কাঠামোকে দায়ী করা যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ফলে এদেশে নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী জাগরণের সূচনা হয়।

অতীতের তুলনায় বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহন বাড়লেও নারী এখনো নানা জায়গায় নানা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। এসব বৈষম্যের কারন খুঁজতে গেলে সেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, রাষ্ট্রীয় বৈষম্যপূর্ণ আইন-কানুন, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকার উপস্থিতিই দেখা যায়।

জেন্ডার বৈষম্যের আলোচনায় তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারদের বৈষম্যের কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের স্বীকার হয় এই ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ই। সমাজে এদেরকে ব্যাঙ্গ করে 'হিজড়া' বলা হয়। এরা ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের পাশাপাশি আইনগত ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও বৈষম্যের স্বীকার হয়। বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি না থাকায় এরা জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও সরকারী চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের স্বীকার হয়।

মানব জাতির ইতিহাস সভ্যতার উত্থান ও পতনের ইতিহাস। সভ্যতার এই উত্থান-পতনের ইতিহাস রচনায় নারী-পুরুষ উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একটি আধুনিক, আদর্শ ও উন্নত সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ সবার ভূমিকাকে স্বীকার করে হাতে হাত রেখে কাজ করার বিকল্প নাই।

Friday, November 20, 2015

হে ফেস্টিভ্যাল থেকে ঢাকা লিট ফেস্ট!

বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব হে-অন-ওয়ে ফেস্টিভ্যালের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১১ সালে প্রথমবারের মত ঢাকা ব্রিটিশ কাউন্সিলে হে ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত হয়। মূলত বিশ্বজুড়ে হে উৎসবকে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা থেকেই হে কর্তৃপক্ষ ঢাকায় হে সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে।

পরবর্তীতে ২০১২ সাল থেকে বাংলা একাডেমিতে বেশ বড় পরিসরেই এই উৎসবটি নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে। প্রথম দিকে এ উৎসব আয়োজনে ডেইলি স্টার ও ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রধান ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রনালয়, বাংলা একাডেমি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহ এর পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসে।

ঢাকায় হে ফেস্টিভ্যাল আয়োজনের উদ্দেশ্য হিসেবে আয়োজকরা বিশ্বের দরবারে হাজার বছরের বাংলাদেশী সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরার কথা বলেন। বিদেশী কবি-সাহিত্যিক-লেখক, মিডিয়া ও প্রকাশকদের সাথে এ দেশের কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের মধ্যে যেন একটি সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে তার কথা বলেন।

হে ফেস্টিভ্যাল আয়োজনের পঞ্চম বছরে এসে আয়োজকরা তার নাম পরিবর্তন করে ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভ্যাল বা ঢাকা লিট ফেস্ট করেন। এর কারন হিসেবে আয়োজকরা বিদেশী প্রতিষ্ঠান
হে-অন-ওয়ের নাম ব্রান্ডিংয়ের পরিবর্তে ঢাকা তথা বাংলাদেশ নামের ব্রান্ডিংয়ের উদ্দেশ্যের কথা বলেন।

হে উৎসব বা ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম একটা থিম 'বাংলাদেশের লেখা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া’ যার অংশ হিসেবে প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সাময়িকী ওয়াসাফিরি প্রথমবারের মতো এ বছর বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিষয় করে পুরো একটি বিশেষ সংখ্যা বের করছে। এটাকে আয়োজকরা এই উৎসবের একটি সফলতা হিসেবে দেখছেন।

সমালোচকদের কেউ একে 'হায় হায় উৎসব' আবার কেউ বড়লোকদের সাহিত্য উৎসব বলে অভিহিত করেন। কেউ আবার ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের কন্যা ইংরেজি ঔপন্যাসিক তাহমিমা আনামকে দেশে ও বিদেশে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয়ার উদ্দেশ্যের কথাও বলেন।

এ কথা সত্য যে উৎসবের প্রধান উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের কন্যা তাহমিমা আনাম, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান যাত্রিকের কর্ণধার সাদাফ সায, ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক কাজী আনিস আহমেদ ইংরেজী ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। হে উৎসব বা ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজনে তাই তাদের ব্যাক্তিগত উৎসাহ বা স্বার্থ থাকলেও আমি সেটাকে খুব বেশি নেগেটিভলি দেখার পক্ষপাতী না।

হে উৎসব বা ঢাকা লিট ফেস্টের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বসাহিত্যকে বাংলাদেশের কাছে নিয়ে আসা এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরা। বিশ্বায়নের যুগে তাই এই ধরনের ফেস্টিভ্যালের গুরুত্বকে অস্বীকার করার সুযোগ নাই।

হে ফেস্ট বা ঢাকা লিট ফেস্টে যে শুধু সাহিত্য নিয়েই আলোচনা হয়, তা কিন্তু নয়। ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, নারীবাদ, জেন্ডার ইস্যু প্রভৃতি নিয়েও নানা সেমিনার, আলোচনা ও মতবিনিময় হয়ে থাকে। এই যেমন আজ লিট ফেস্টিভ্যালের দ্বিতীয় দিনে আমার একাডেমিক ইন্টারেস্টের জায়গা মাইনোরিটি ও জেন্ডার ইস্যু রিলেটেড সেক্স ওয়ার্কার ও উইমেন এম্পাওরমেন্টের উপর দুটি ইন্টারন্যাশনাল ডিসকাশনে অংশগ্রহন করলাম।

হে ফেস্ট তথা ঢাকা লিট ফেস্টে টানা তিন বছরের অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা থেকে আমার উপলব্ধি হচ্ছে বিশ্বায়নের যুগে এ ধরনের ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্কলার, লেখক, সাহিত্যিক ও নানা ফিল্ডের প্রমিনেন্ট এক্টিভিস্টদের চিন্তার সাথে পরিচয় ও মিথস্ক্রিয়ার এই সুযোগ দেশের তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের জন্য ঢাকা লিট ফেস্ট চমৎকার এক উপলক্ষ বলে মনে করি।

Friday, November 6, 2015

নারীবাদ কী ও কেন : একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা!

মানুষ হিসেবে নারীর পরিপূর্ণ অধিকারের দাবীর নাম নারীবাদ। নারীবাদ ইংরেজি feminism শব্দটি থেকে এসেছে। কোন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বা সমাজবিজ্ঞানের মতবাদকে 'বাদ' বা ism বলা হয়। সেই হিসেবে নারীবাদ এমন একটি বাদ বা মতবাদ যা সমাজবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট, যেখানে নারী অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। তো, কী সেই অধিকার? পুরুষের সমান অধিকার, মানুষের অধিকার।

নারীবাদ নারীদের আন্দোলন নয়, নারীদের জন্য আন্দোলন। নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নারীবাদীদের মধ্যে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বা মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে।

এই মতাদর্শগত পার্থক্য ব্যাপারটা কেমন তা একটা উদাহরন দিলে সহজেই বোঝা যাবে। যেমন ইসলাম ধর্মের কথাই ধরা যাক। মুসলমানদের মধ্যে অনেক সাবগ্রুপ রয়েছে। এদের সবার উদ্দেশ্য এক তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হলেও এদের নীতি ও কর্ম-পদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন, তাবলিগ জামাতের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্বশুদ্ধির আন্দোলন, জামাতে ইসলামের রাজনৈতিক আন্দোলন, পীর-মুরশিদদের আধ্যাত্মিক আন্দোলন ও আল-কায়েদার জিহাদি আন্দোলন।

তেমনি সব নারীবাদের মূল উদ্দেশ্য এক তথা নারীমুক্তি হলেও এদের নীতি ও কার্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে। এই মতাদর্শগত পার্থক্য থেকে বিভিন্ন নারীবাদের উৎপত্তি হয়েছে।

কয়েকটি প্রভাবশালী ও আলোচিত নারীবাদ হল- উদারনৈতিক নারীবাদ, আমূল নারীবাদ, মার্ক্সীয় নারীবাদ, পরিবেশ নারীবাদ ইত্যাদি।

(১) উদারনৈতিক নারীবাদ (Liberal Feminism)

উদার নারীবাদের মূল কথা হচ্ছে প্রতিটা মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। উনিশ শতকে উদার নারীবাদের লক্ষ ছিল গনতান্ত্রিক নির্বাচনে নারীদের ভোটাধিকার অর্জন। বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভোটাধিকার অর্জন করতে পারলেও আজও পৃথিবীর অনেক দেশে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।

উদারনৈতিক নারীবাদীরা মূলত সমাজসংস্কারে বিশ্বাসী। এরা মনে করে, বিদ্যমান সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান, আইন-কানুন সংস্কার ও সংশোধন করে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও অসমতা দূর করা সম্ভব।

বর্তমান যুগের উদার নারীবাদীদের দাবী হচ্ছে নারীদের যোগ্যতা অনুসারী যেকোন পেশা বেছে নেয়ার অধিকার থাকতে হবে। এক্ষেত্রে নারীদের কম বেতন দেয়া চলবেনা।

এরা আরো দাবী করেন যে, নারী যেহেতু সন্তান জন্ম দিয়ে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে, তাই সন্তান প্রসবকালীন সময়ে নারীদের সবেতন ছুটি দিতে হবে। আর শিশু যেহেতু নারীর একার নয়, তাই শিশু পালনে পুরুষদের অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে।

মেরি ওলস্টোন ক্রাফট, জন স্টুয়ার্ট মিল, হ্যারিয়েট টেইলর উদার নারীবাদের প্রবক্তা। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই ধরনের নারীবাদের সমর্থক ছিলেন। বাংলাদেশে মূলত যে ধরনের নারীবাদের চর্চা বা আন্দোলন দেখা যায় তা মূলত এই উদারনৈতিক নারীবাদই।

(২) আমূল নারীবাদ (Radical Feminism)

এই নারীবাদের মুলকথা হল পুরুষ নারীকে শোষন করে যৌন নিগ্রহের মাধ্যমে। এরা নারী-পুরুষের বিচ্ছেদে বিশ্বাসী। পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি ও পুরুষের সংগে নারীর সম্পর্ককে অস্বীকার করে নারীর স্বাতন্ত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই নারীবাদীরা।

আমূল নারীবাদীরা পুরুষকে প্রতিপক্ষরুপে চিহ্নিত করে প্রচলিত বিবাহ রীতিকে অস্বীকার করে। এরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী যাতে রাষ্ট্র ও পুরুষদেরও মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখার দায় সমানভাবে বহন করতে হয়। এরা সমকামে বিশ্বাসী ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী-পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী।

শুলে মিটেল ফায়ারস্টোন, কেট মিলেট, মারিয়েন ফ্রেঞ্চ আমূল নারীবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিনকে এই ধরনের নারীবাদের চর্চা করতে দেখা যায়।

নারীবাদের এই ধারাকে অনেকে উগ্র নারীবাদ বলে অভিহিত করেন। নারী-পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এরা মূলত পুরুষতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে পুরুষতন্ত্রেরই উল্টোপিঠ নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় বলেও অনেকে আমূল নারীবাদের সমালোচনা করেন।

(৩) মার্ক্সীয় নারীবাদ (Marxist Feminism)

মার্ক্সীয় নারীবাদ মতে পুঁজিবাদ আর পুরুষতন্ত্র অবিচ্ছেদ্য। একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। এই মতবাদ অনুসারে ব্যক্তিমালিকানা বা শ্রেনীবৈষম্য হচ্ছে নারী নির্যাতন ও শোষনের কারন। পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই নারী মুক্তি সম্ভব বলে এরা মনে করেন।

মার্ক্সীয় নারীবাদে পরিবার সংগঠনের মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের যাবতীয় আর্থিক দায়-দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত। সাম্যবাদী সমাজের বিয়েতে থাকবেনা কোন ধরনের আর্থিক বা ভরণ-পোষণের দ্বায়িত্ব নেয়ার চুক্তি। ফলে নারী-পুরুষের সম্পর্ক গড়ে উঠবে তাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর, পারস্পারিক বোঝাপড়া ও ভালবাসার উপর।

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের রচনাকে ভিত্তি করে এই নারীবাদ রচিত। লেনিন, অগাস্ট বেবেল, ক্লারা জেটকিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমূখ পরবর্তীতে এই মার্কসীয় নারীবাদে ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশে নারীবাদ: একটি পর্যালোচনা

বাংলাদেশে নারীবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয় হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীবাদের তুলনায় তা একটু ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে আমূল নারীবাদের প্রভাব না থাকলেও এদেশের নারীবাদের ইতিহাসে আমূল পরিবর্তন এসেছে।

উপমহাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যুগযুগ ধরে নারীরা পুরুষ কর্তৃক শোষন ও নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আসছে। পারিবারিক কাঠামোর মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র নারীকে বন্দী করে রেখেছে কখনো সমাজের নামে, কখনো ধর্মের নামে আবার কখনো পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে। এছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার যেমন সতিদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির মাধ্যমে নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের হাত ধরে বাংলায় যে ধরনের নারীবাদের চর্চা ও আন্দোলনের শুরু হয় তা মূলত উদারনৈতিক নারীবাদই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আধুনিক সময়ের বাংলাদেশে এখনো ডমিনেন্ট ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট হিসেবে এই উদারনৈতিক নারীবাদ চর্চারই জয়জয়াকার দেখা যায়।

বাংলাদেশে উদারনৈতিক নারীবাদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও আমূল নারীবাদের কথাও শোনা যায়। আমূল নারীবাদ নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলেন তসলিমা নাসরিন।

বাংলাদেশে নারীবাদ বিষয়ে যারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন তাদের মধ্যে সারা হোয়াইট, ক্রিস্টার্ন ওয়েস্টগার্ড ও ভ্যানশেন্ডেল, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, নায়লা কবির, রওনক জাহান, মাহমুদা ইসলাম, নাজমা চৌধুরী, খালেদা সালাহ উদ্দীন, মেঘনা গুহ ঠাকুরতা ও আনু মুহম্মদ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মভীরু ও স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি বেশি অনুরক্ত থাকায় আমূল নারীবাদ এদেশে কোন প্রভাব ফেলতে না পারলেও উদারনৈতিক নারীবাদী আন্দোলন এখানে বেশ সমাদৃত ও সফল হয়েছে বলা যায়।

Sunday, November 1, 2015

সমাজবিজ্ঞানের বই কোথায় পাবেন?

সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর প্রায় সব স্টুডেন্টদের একটা কমন কৌতূহল থাকে যে সমাজবিজ্ঞানের বইগুলো কোথায় পওয়া যায়! চলুন, তাহলে জেনে নেয়া যাক।

১। সেমিনার রুম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি।

সমাজবিজ্ঞানের প্রায় সব ধরনের বই পাবেন সেমিনারে। আপনি যে কোর্সই পড়েন না কেন সব কোর্সের জন্যই অন্তত দুই/চারটা বই এখানে পাবেনই। তবে সেমিনারের বেশিরভাগ বইগুলো ইংলিশ টেক্সট। এখানে কেউ কাংখিত বই খুঁজে না পেলে সেমিনারের নাসির ভাইয়ের কাছ থেকে হেল্প নিতে পারবেন।

২। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, ঢাবি।

এখানেও সেমিনারের বেশিরভাগ বইগুলো পাবেন। এর বাইরে অন্য ডিসিপ্লিনের কিন্তু সোসলজির সাথে সম্পর্কিত বা সোসলজি বুঝতে সহায়ক এমন সব বই পাবেন। প্রবলেম একটাই....সেটা হল এখানকার বেশিরভাগ বইই সেই ইংলিশে লেখা। ;)  

৩। সুফিয়া কামাল গন-গ্রন্থাগার, শাহবাগ।

সরকারী এই লাইব্রেরিতে প্রচুর বই আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে প্রত্যেক ডিসিপ্লিন বা সাবজেক্টের বইগুলো আলাদা আলাদা শেলফে সাজিয়ে রাখা আছে। যেমন সমাজবিজ্ঞানের জন্য আলাদা বইয়ের শেলফ, সাহিত্যের জন্য আলাদা শেলফ। এমনিভাবে সাইকোলজি, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি সব বিষয়ের জন্য এমন আলাদা আলাদা তাকে বইগুলো সাজিয়ে রাখা আছে।

এই লাইব্রেরির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এখানকার সব বই বাংলা। অবশ্য লাইব্রেরির ৩য় তলায় ইংরেজি বইও আছে এখানে।

আমার মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথমদিকে প্রত্যেক সেমিস্টারের শুরুতে প্রত্যেক কোর্সের উপর দুই/তিনটা বাংলা বই পড়ে ফেলতাম। যার ফলে পুরো কোর্স সম্পর্কে একটা সাধারন ধারনা তৈরি হত। কনসেপ্ট সম্পর্কে আগেই ধারনা তৈরি হওয়ার ফলে ক্লাস যেমন ভাল লাগতো তেমনি ক্লাসে স্যারের সাথে ইন্টারেকশনও ভাল করতে পারতাম।

৪। কল্লোল বুক সেন্টার
দোকান নং ১৪৪-/১৪৫
ইসলামিয়া মার্কেট, নীলক্ষেত।

এটা একটা বাংলা বইয়ের দোকান। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সমাজবিজ্ঞানের একাডেমিক সকল বাংলা বই এখানে পাওয়া যায়। সমাজবিজ্ঞানের কোর্স ভিত্তিক অনেক বাংলা বই আছে। সেগুলোও এখান থেকে সংগ্রহ করা যাবে।

৫। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি, ফুলার রোড।

নাম দেখে বুঝতেই পারছেন এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল লাইব্রেরি। সমাজবিজ্ঞানের কিছু বইয়ের অরিজিনাল কপি পাবেন এখানে। এছাড়া, অন্যান্য ডিসিপ্লিনের সেরা সেরা বইও পড়তে পারবেন এখানে। তবে এখানে পড়তে হলে বা বই বাসায় নিতে চাইলে মেম্বার হতে হবে। অবশ্য মেম্বার না হলেও আপনি এই লাইব্রেরি ঘুরে দেখে যেতে পারবেন।

৫। এভ্রিহয়ার ;)

আসলে জগতে যত বই আছে সব বইয়ের ভিতরই সোসলজি লুকায়িত আছে। তাই, সোসলজির দৃষ্টিভঙ্গি ডেভেলপ করতে চাইলে বই পড়ুন, সব ধরনের বই পড়ুন।

একটা কথা মনে রাখলে ভাল, ইংলিশ আপনি জানেন বা না জানেন, সমজাবিজ্ঞান পড়তে হলে আর ভাল করে বুঝতে চাইলে আল্টিমেটলি ইংলিশ বইই আপনাকে পড়তে হবে।

কিছু বাংলা বই হয়তো আপনাকে শুরুর দিকে সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা তৈরিতে সাহায্য করবে। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর দেখবেন, ভাল মানসম্পন্ন বাংলা সমাজবিজ্ঞানের বইয়ের প্রচন্ড অভাব রয়েছে। তাই ইংরেজি শেখার কোন বিকল্প নাই।